‘একাত্তরের জননী’ হিসেবে সমধিক পরিচিত লেখিকা ৭৬ বছর বয়সী রমা চৌধুরী গুরুতর অসুস্থ হয়েও চিকিৎসার ব্যয় ভার বহন করতে না পেরে ক্লিনিক ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এই খবরটি সোশাল মিডিয়ায় এলে সাধারণ মানুষ ও সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের ব্যক্তিরা খোঁজ নিতে শুরু করেন। পোস্ট দাতা সমরেশ বৈদ্য অবাক হয়ে যান। স্বাস্থ্য ও সমাজসেবার সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এককভাবে এরকম অনেক নজির সৃষ্টি করেছেন কিন্তু যৌথভাবে সম্ভবত এবারই প্রথম। কাজ কতোদূর হয়েছে তার চেয়ে বড় কথা এমন আন্তঃবিভাগীয় আন্তরিক সমন্বয় মানুষকে দারুণভাবে আশান্বিত করেছে যে কাজ হবে।
একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে শুধু সম্ভ্রম হারাননি একে একে তিন সন্তানকেও হারিয়েছেন। পুত্রদের হিন্দু ধর্মমতে দাহ না করে মাটিতেই সমাহিত করেছেন বলে সেই মাটির উপরে নগ্ন পায়েই হাঁটেন তিনি। নিজের সন্তানেরা শহীদের মর্যাদা পায়নি, কিন্তু তাঁর কাছে ওরা শহীদ। একাত্তর তাঁকে দিয়েছে পোড়া ভিটে, কাঁধের ঝোলা, ছেলের শোক আর খালি পা।
বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে যে কয়েকজন বীরাঙ্গনার ইতিহাস জড়িয়ে আছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম রমা চৌধুরী। দক্ষিণ চট্টগ্রামের তিনিই প্রথম নারী, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা ১৮টি যার মধ্যে ‘একাত্তরের জননী’ ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। তিনি নিজেই নিজের বই নগ্ন পায়ে ফেরি করে বিক্রি করেন প্রায় তিন দশক ধরে। এ থেকে প্রতি মাসে তাঁর হাজার বিশেক টাকার মতো আয় হয়। এ দিয়েই তিনি থাকা খাওয়ার সংস্থান করেন। ব্যক্তিগত সহায়-সম্পত্তি বলতে তেমন কিছুই নেই। জীবনে কারো কাছ থেকে তিনি কোন আর্থিক বা বৈষয়িক সাহায্য নেননি। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও নয়। শুধু তাঁর কাছ থেকে বই কিনলেই টাকা নিয়েছেন, এ ছাড়া নয়। একই সঙ্গে পরিচালনা করছেন ‘দীপংকর স্মৃতি অনাথালয়’ নামে একটি অনাথ আশ্রম। দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে অনাথ আশ্রম খুলতে চান। সকল ধর্মের অনাথরা সেখানে থাকবে।
রমা চৌধুরী পুত্রশোক ভুলে থাকেন পোষা বিড়ালগুলোকে কোলে নিয়ে। আর আছেন তাঁর বইয়ের প্রকাশক আলাউদ্দিন খোকন যে মায়ের মতো করেই তাঁর দেখাশুনা করেন। একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যে সক্রিয়তা দেখা গেছে তাতে মনে হয়েছে কর্মকর্তা নয় তাঁরা এই ‘একাত্তরের জননী’র এক এক জন সন্তান, এক এক জন আলাউদ্দিন খোকন হয়ে উঠেছেন।
প্রথম সন্তান
সমরেশ বৈদ্য, দৈনিক ভোরের কাগজের চট্টগ্রাম ব্যুরো চীফ ১৯ জুন সোশাল মিডিয়ায় লেখেন -‘একাত্তরের জননী’র লেখিকা হিসাবে সমাধিক পরিচিত, বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি হয়েও চিকিৎসার অতিরিক্ত ব্যয় ভার বহন করতে না পেরে ক্লিনিক ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। জীবনে কারো কাছ থেকে তিনি কোন আর্থিক বা বৈষয়িক সাহায্য নেননি। শুধুমাত্র তার কাছ থেকে বই কিনলেই টাকা নিয়েছেন, এ ছাড়া নয়। কিন্তু তিনি এখন খুব অসুস্থ। তাঁর চিকিৎসা করানোর জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন’।
দ্বিতীয় সন্তান
জনাব সমরেশ বৈদ্যের পোস্টটি ২৪ জুন এটুআই এর ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট জনাব মানিক মাহমুদ শেয়ার করেন এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব জনাব সিরাজুল খান ও সমাজসেবা অধিদফতরের মহা পরিচালক জনাব গাজী কবিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
তৃতীয় সন্তান
সিরাজুল খান, সচিব, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ঐ রাতেই সিভিল সার্জন, চট্টগ্রাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ও বর্তমানে চট্রগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির সেক্রেটারী জনাব জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে ইনবক্স করেন। ঠিক হয় তাঁরা দুজন রমা চৌধুরীর কাছে যাবেন এবং তাঁকে হসপিটালে ভর্তি করে চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা করবেন।
সচিব মহোদয় এখানেই থেমে থাকেননি। ঈদের দুদিন পরে তিনি সশরীরে রমা চৌধুরীকে দেখতে হসপিটালে যান। আবেগতাড়িত হয়ে তিনি লিখেছেন – ‘আমি দু’মাস আগেও স্বাস্হ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলাম অর্থাৎ দেশের চিকিৎসা সেবার বড় একটি দায় আমার ছিল। এখন আমি মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত। চিকিৎসা সেবা আমার দায়িত্বের মধ্যে পডে না। কিন্তু এই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ কি আমার আছে? নাই। অতএব পোস্টি কপি করে প্রথমত: সিভিল সার্জন, চট্রগ্রামকে ইনবক্স করে অনুরোধ করলাম চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বন্ধু জাহাঙ্গীর চৌধুরী চট্রগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির সেক্রেটারী। রমা চৌধুরীর ডায়াবেটিক সমস্যা আছে বলে পোস্টে উল্লেখ ছিল। সুতরাং ওঁকেও ইনবক্স করে অনুরোধ করলাম চিকিৎসার বিষয়ে সাহায্যের জন্য। রাত সাডে এগারোটার দিকে জাহাঙ্গীর চৌধুরী ফোন করে জানালেন সিভিল সার্জনের সাথে কথা হয়েছে। তাঁরা দু’জন মিলে ব্যবস্থা করবেন। তারপর গতকাল সিভিল সার্জন এবং জাহাঙ্গীর চৌধুরী দু’জনই রমা চৌধুরীর বাসায় গিয়ে অনুরোধ করে হাসপাতালে আসতে রাজী করান। এর আগে সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকেও তাঁর খোঁজ খবর নেওয়া হয়। আজকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক বন্দনা দাসও হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন’।
চতুর্থ সন্তান
গাজী কবির, মহা পরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর সোশাল মিডিয়াতেই চট্টগ্রামের উপ পরিচালক জনাব বন্দনা দাশকে নির্দেশ দেন – ‘রমা চৌধুরীর সাথে দেখা করুন । আমার শ্রদ্ধা জানাবেন তাঁকে । এরপর আমাকে বলবেন আমরা কি করতে পারি। যত্নবান হবেন যাতে কোনোভাবেই তাঁর মর্যাদাবোধে আঘাত না লাগে’। যেন মর্যাদাবোধে আঘাত না লাগে কথাটি বলার কারণ আছে। তাঁর ব্যাপারে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে ২০১৩ সালের ২৭ জুলাই গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নয় বঙ্গবন্ধুর কণ্যার সঙ্গে দেখা করেন রমা চৌধুরী। তবে কোনো ধরনের সাহায্য নেবেন না এ শর্তে। বোঝাই যায় তাঁর মর্যাদাবোধ আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক উপরে। এজন্যই ডিজি মহোদয়ের এই বাড়তি ও যৌক্তিক সতর্কতা।
পঞ্চম সন্তান
আবুল কালাম আজাদ, মহা পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সোশাল মিডিয়ায় চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন জনাব Azizur Rahman Siddiqui এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখেন – ‘দেখুন তো তাকে কি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়?’
ষষ্ঠ ও সপ্তম সন্তান
ডা: আজিজুর রহমান সিদ্দিকী, সিভিল সার্জন, চট্রগ্রাম ও জাহাঙ্গীর চৌধুরী, সেক্রেটারী, চট্রগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি অসাধ্য সাধন করেন। তাঁরা দুজন রমা চৌধুরীর সাথে দেখা করে তাঁকে ডায়াবেটিক হসপিটালে ভর্তি হতে রাজী করান এবং ঈদের পরে ভর্তি করান। যে মানুষটি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো সাহায্য নেননি ২০১৩ সালে তাঁকে এটুকু রাজী করানো কতোটা কঠিন আশা করি পাঠকমাত্রই বুঝবেন।
অষ্টম ও নবম সন্তান
একাত্তরের জননীর কন্যা সন্তানও আছে। বন্দনা দাশ, উপ পরিচালক, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়, চট্টগ্রাম। তিনি ডিজি, সমাজসেবার নির্দেশে রমা চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করেন। তাঁকে সমাজসেবা অধিদফতরের ভাতা, আর্থিক সাহযোগিতাসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানের চেষ্টাও করেন। তাঁর সাথে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সমাজসেবা অফিসার (হাসপাতাল) জনাব অভিজিৎ সাহাও ছিলেন। তাঁর ফেসবুক কমেন্ট থেকে আমরা জানতে পারি-‘উপ পরিচালক জনাব বন্দনা দাশ স্যার অনেক আগেই তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রদান করতে চেয়েছিলেন বলে জানি। সেদিন আবার তাঁর সাথে আলাপকালে তিনি কোন ধরনের ভাতা নিতে আগ্রহী নন বলে জানান’। রমা চৌধুরীর সহকারী জনাব আলাউদ্দিন খোকন এর মতে তাঁর একটি আবাসিক স্বাস্থ্যসম্মত রুম দরকার। বর্তমানে তিনি একটি ছোট অস্বাস্থ্যকর রুমে ভাড়ায় বসবাস করছেন। চট্রগ্রাম জামালগঞ্জ এলাকায় বাসাটি হলে তাঁর খুব উপকার হয়।
উপ পরিচালক বন্দনা দাশ তাঁর লিখিত ৪ টি বই সমাজসেবা অধিদপ্তরাধীন শিশু পরিবার(বালিকা) চট্টগ্রামের লাইব্রেরির জন্য ক্রয় করে একটি পথ দেখিয়েছেন। সরকারীভাবে তাঁর বই কিনেও তো সাহায্য নিতে না চাওয়া মানুষটিকে সহযোগিতা করা যায়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি এই পথে এগিয়ে আসতে পারেন। সকলের ভালোবাসায় তিনি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, দেশব্যাপী সব ধর্মের অনাথদের জন্য আশ্রম গড়ে তুলবেন এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
এখন আর একটি দেখার বিষয় হলো একাত্তরের জননীর সন্তানেরা তাঁর থাকার জন্য কোনো ব্যবস্থা করতে এবং তাঁকে তা গ্রহনে রাজী করাতে পারেন কিনা। আর কেউ না পারলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো পারবেন। মমতাময়ী মেয়েরা অনেক কিছু পারেন।