তিন পুত্র পুলিশ কর্মকর্তা, এক কন্যা সরকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা অথচ তাদের গর্ভধারিণী মা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে। এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা ক্ষুদ্রকাঠী গ্রামের মৃত্যু আইয়ুব আলী সরদারের স্ত্রী মোসাঃ মনোয়ারা বেগমের (৮০) । ২০১৪ সালের স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে এই অবস্থা। স্বামীর মূল ভিটা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় ইজিবাইক চালক ছেলের কাছেই থাকতেন তিনি। শোনা যায় ছোট ছেলেকে দুই শতক জমি লিখে দেয়ার অজুহাতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি হয়। অযত্নের অত্যাচারে আর বয়সের ভারে এখন তিনি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতেও পারেন না। কয়েক বছর আগে স্ট্রোক হওয়ায় মানসিক ভারসাম্যও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কয়েক মাস আগে পা ফসকে পড়ে গিয়ে কোমরের হাড়ও ভেঙ্গে যায়। সেই থেকে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার ক্ষুদ্রকাঠী গ্রামের এই অভাগা মা বাবুগঞ্জ স্টীল ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তের একটি খুঁপরী ঘরে বিনা চিকিৎসায় বেঁচে আছেন।
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ খ্রিঃ তারিখ প্রথমে ‘বরিশাল ট্রিবিউন’ এ ‘মাকে দিয়ে ভিক্ষা করায় ৩ পুলিশ সন্তান’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সাথে সাথে বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শেখ মো. টিপু সুলতান বাবুগঞ্জ উপজেলার ইউএনও দীপক কুমার রায়কে ঐ মা মনোয়ারা বেগমের চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। ইউএনও মহোদয় সেই বাড়িতে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে ঐ মাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে তিনি ঐ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের ৪০৩ নম্বর কক্ষের বি-১৩ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন আছেন।
তিন বিভাগের ভূমিকা
দুপুর ২টার ৫ মিনিট আগে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘তিন ছেলে পুলিশ কর্মকর্তা, তবু ভিক্ষা করেন মা!’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। দেড় ঘন্টার মধ্যে সমাজসেবা অধিদফতরের উপ পরিচালক জনাব সাজ্জাদ রাঙ্গা ফেসবুক পোস্টে ডিডি, এডিকে সহায়তা করতে অনুরোধ জানিয়ে সত্বর ডিজি মহোদয়কে অবহিত করতে বলেন। উপজেলা সমাজসেবা অফিসার, বাবুগঞ্জ জনাব মাহমুদ হাসিব সরেজমিনে গিয়ে জানতে পারেন তাঁকে ইতোমধ্যে বরিশাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিকেলে ডিডি, সমাজসেবা জনাব মোশাররফ হোসেন, এডি, হাসপাতাল সমাজসেবা অফিসার এবং বাবুগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিসারকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসাসহ সার্বিক খবর নেন।
পরের দিন মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন বরিশালের জেলা প্রশাসক মোঃ হাবিবুর রহমান। তিনি হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে অসহায় চিকিৎসাধীন মায়ের শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে তার কথা শোনেন এবং চিকিৎসা ও দেখাশুনার জন্য নগদ ১২,০০০/- টাকা প্রদান করেন। এসময় তিনি উপস্থিত সমাজসেবা কর্মকর্তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করার জন্য বলেন।
একই দিনে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে অসহায় চিকিৎসাধীন মায়ের আকুল আর্তনাদের কথা শোনেন বরিশাল জেলার পুলিশ সুপার, জনাব মোঃ সাইফুল ইসলাম, বিপিএম । তিনি তার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার এর দায়িত্ব গ্রহনসহ চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে নগদ ১০,০০০/- টাকা প্রদান করেন।
২০ সেপ্টেম্বর বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি জনাব শফিকুল ইসলাম বিপিএম হাসপাতালে দেখতে গিয়ে তাৎক্ষনিকভাবে এই অসহায় মায়ের চিকিৎসার জন্য নগদ ১৫০০০/- টাকা প্রদান করেন। তিনি বলেন যে এই অসহায় নারীর চিকিৎসার ব্যয়ভার পুলিশের পক্ষ থেকে বহন করা হবে এবং তার অনুমতি ও তদন্ত সাপেক্ষে প্রচলিত আইনে তার সন্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
সোশাল মিডিয়ার ভুমিকা
পত্রিকায় তো এমন কতো অসহায় মানুষের খবরই ছাপা হয় এবং হয়েছে। তাতে কিছু কাজও হয়। কিন্তু তিন তিনটি বিভাগ (সমাজসেবা অধিদফতর, পুলিশ বিভাগ এবং জেলা প্রশাসন) এই অসহায় মায়ের পাশে যেভাবে এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে সোশাল মিডিয়ার ভূমিকা সর্বাধিক বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। সোশাল মিডিয়ায় হাজার হাজার কমেন্ট আর শত শত শেয়ারের একটি সমন্বিত চাপ আছে যা পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হবার চাপের চেয়ে বেশী শক্তিশালী। সোশাল মিডিয়ায় ঐ সন্তানদের বিরুদ্ধে মামলা করার দাবী জানিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। সম্ভবত সেজন্যই বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি মহোদয় প্রেস ব্রিফিং এর মাধ্যমে উপস্থিত মিডিয়ার সামনে সমস্যা সমাধান সংক্রান্ত বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করেন যা নজিরবিহীন। এই মুহূর্তে বরিশাল হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের বি-১৩ বেডের পাশে ৬ সন্তানকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে সোশাল মিডিয়ার সর্বব্যপী শক্তির প্রমাণ দেয় আর অমিত সম্ভাবনার আশা জাগায়।
গৃহীত ব্যবস্থাদি
মাতা পিতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩ অনুযায়ী সন্তানরা পিতা-মাতার খোঁজ খবর রাখতে বাধ্য। তাই ২১ সেপ্টেম্বর জনাব মোঃ শফিকুল ইসলাম পিপিএম, ডিআইজি, বরিশাল রেঞ্জ মনোয়ারা বেগমের সন্তানদের কাছ থেকে এই মর্মে অঙ্গীকারনামা নেন যে, তারা পর্যায়ক্রমে ১৫ দিন করে দায়িত্ব পালন করে মায়ের সুস্থতার জন্য চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাবেন। এর মধ্যে কোন গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরপর সুস্থ হয়ে উঠলে তিনি যার কাছে থাকতে চাইবেন তার কাছেই তাকে হস্থান্তর করা হবে। অন্য সন্তানরা তাকে সহায়তা করবেন। পুর্নাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে এই কমিটি ডিআইজি মহোদয়ের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। ইতোমধ্যে স্কুল শিক্ষিকা মেয়েকে শোকজ করেছেন বাবুগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। এদিকে চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের শান্তি নিবাস, বরিশালে বৃদ্ধা নারীকে রাখার জন্য ডিজি, সমাজসেবা ইতোমধ্যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
গত মে মাসে ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়ীয়া উপজেলার তেজপাটুলি গ্রামের মৃত মোসলেম উদ্দিনের স্ত্রী মরিয়ম নেছাকে সন্তানেরা গোয়ালঘরে ফেলে রাখায় শিয়াল কামড়ে তার পায়ের মাংস খেয়ে ফেলার ঘটনায় প্রাথমিকভাবে আমরা সমাজসেবা অধিদফতরের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে দেখেছিলাম।পরে অবশ্য এমপি এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীও মরিয়ম নেছার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেন।
এবারের এই ঘটনায় যথারীতি সমাজসেবা অধিদফতর প্রশংসনীয়ভাবে এগিয়ে এসেছে। সমাজসেবা অধিদফতরের মানবিক মহাপরিচালক জনাব গাজী কবির ও তাঁর দল এমন শত শত উদাহরণ তৈরী করেছেন গত ২ বছরে। এখানে জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ এবং উপজেলা প্রশাসনও এগিয়ে এসেছেন। সাধুবাদ জানাই তাঁদের। মনে হলো ঈশ্বর যেন দায়িত্বহীন ৬ ছেলের ঘাটতি পূরণ করলেন উচ্চপদস্থ ৬ জন জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাকে যুক্ত করে।