কিছু দিন আগ পর্যন্ত অনেকের মতো আমিও সোশাল মিডিয়াকে একটু কমই গুরুত্ব দিতাম। যাদের অলস সময় আছে,ভাবতাম এসব তাদের কাজ। সরকারী চাকুরীর ভাব গাম্ভীর্যের সাথে ফেসবুক, টুইটার ঠিক যায় না। তাই ফেসবুকের ‘পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশন বাংলাদেশ’ গ্রুপে প্রায় আড়াই বছর আগে যুক্ত হলেও কখনো কিছু পোস্ট করিনি। মাঝে মাঝে লাইক দিয়েছি, কদাচিৎ কমেন্টও করেছি। ঐ পর্যন্তই। তখন অবশ্য গ্রুপটা এতো শক্তিশালী আর জনপ্রিয় ছিলো না।
কিছুটা দ্বিধা নিয়েই সম্ভবত সচিব হিসাবে প্রথম নিজ মন্ত্রণালয়ের মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম পরিদর্শন করে গত বছর ২৩ ডিসেম্বর সেন্ট মার্টিনের ১০ শয্যার হাসপাতালের দুজন ডাক্তারের একজন দু’বছর ধরে নিখোঁজ, অব্যবহৃত সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, প্যাকেটবদ্ধ কম্পিউটার, ধূলাজমা ফাইলপত্র নিয়ে একটি পোস্ট দেই। আমার অনেক সচিব বন্ধুই সমালোচনা করেছেন দাপ্তরিক পরিদর্শণকে এভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার জন্য। তাঁরা বোঝাতে চেয়েছেন নিজের মন্ত্রণালয়কে নিজেই জনসমক্ষে এভাবে হেয় করে ঠিক করিনি।
খানিকটা দ্বিধা নিয়েই আর হেয় করবো না ঠিক করলাম। তবে মাঝে মাঝে গ্রুপে ঢুকে বিভিন্ন বিষয় বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিষয়ক পোস্টগুলো দেখতাম। কিন্তু মন্ত্রণালয়কে হেয় করবো না বলে কমেন্ট করাও ছেড়ে দিলাম। কিন্তু গত ২৮ জানুয়ারীর রংপুর মেডিকের কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের মেয়েদের আবাসিক সমস্যা নিয়ে ৩ লাইনের একটি পোস্ট পড়ে হতবাক হয়ে কমেন্ট করে ফেললাম। পোস্টটিতে যে ভাষা প্রয়োগ করা হয় এবং ছবি যুক্ত করা হয় তা যে কোনো বিবেকবান মানুষকে নাড়া দেবে। আমাকেও দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৪০তম নির্বাহী পরিষদের সভায় যোগদানের জন্য আমি তখন জেনেভায়। তাই শুধু লিখলাম – দেশে ফিরে বিষয়টি দেখবো। কয়েক ঘন্টার মধ্যে এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মহোদয় ধন্যবাদ দিয়ে দ্রুতই সমাধান হবে আশা নিয়ে কমেন্ট করলেন। এরপর আর দেরী না করে জেনেভা থেকেই রমেক এর প্রিন্সিপ্যালকে পুরো পোস্টটি এসএমএস করলাম। অভিযোগের সত্যতা আছে জেনে তাঁকে দ্রুত ২/৩ দিনের মধ্যে অন্তত সাময়িক সমাধানের নির্দেশ দিলাম। রমেক অধ্যক্ষ অনিমেষ মজুমদারকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানচ্ছি কারণ কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেবার চেয়ে নির্দেশ প্রতিপালন করা বেশী কঠিন। পরের দিন জেলা প্রশাসন রংপুরের তরফ থেকে কমেন্ট করা হলো পিডব্লিউডির এক্সইএনকে অনুরোধ করা হয়েছে ভাইস প্রিন্সিপালের কোয়ার্টারটি দ্রুত সংস্কার করতে। জনাব অনিমেষ মজুমদার দ্রুততম সময়ে ভাইস প্রিন্সিপ্যালের অব্যবহৃত কোয়ার্টারটি সংস্কার করিয়ে এক সপ্তাহের মাথায় ছবিসহ কমেন্ট করে জানালেন সংস্কারের কাজ শেষে ডেন্টাল ইউনিটের মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কিন্তু বিষয়টি এখানেই শেষ হলো না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বর্তমান মুখ্য সচিব মহোদয় প্রিন্সিপ্যালকে এ বিষয়ে করণীয় ও গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে অবিলম্বে একটি রিপোর্ট পাঠাতে বললেন। আর কেবিনেট ডিভিশনের সংস্কার ও সমন্বয় সচিব কমেন্ট করলেন – সমস্যাটির স্বল্পমেয়াদী সমাধান হলেও দীর্ঘ মেয়াদে সমাধান এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এ ধরণের সমস্যার সমাধানের জন্য এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মহোদয়ের নির্দেশনামতে আলোচনা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।
এর মাঝে আরো কয়েকটি পোস্ট চোখে পড়লো। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্রিগেডিয়ার নাসির অসাধারণ কাজ করছেন। একজন সেবাগ্রহীতা ফেসবুকে লিখেছেন আপনার কথা শুনেছি, দেখিনি কখনও, আমার বাবা কিছুদিন আগে আপনার হাসপাতালে মারা গেছেন কিন্তু আমি হাসপাতালের সেবায় সন্তুষ্ট। সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব শুধু চোখে নয় চোখের মণির মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাই এভাবে যে, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই আমি জেনেছি রাজশাহীতে ডেন্টাল ইউনিট/কলেজের জন্য উদ্বোধনকৃত ভবন প্রায় অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। রাজধানীতে বসে এমন ভবন তৈরীর অনুমোদন দেই অথচ তৈরী হয়ে পড়ে থাকা ভবন সম্পর্কে অনেকসময় জানাও যায় না। বরগুনার আমতলির দু্ই সহোদর ‘ডুশনি মাসকুলার ডিসট্রফি’ রোগে ভুগছে। বড় ছেলেটিকে হয়তো বাঁচানো যাবে না কিন্তু ছোট ছেলেটিকে মোটামুটি সুস্থ করা যাবে বলে আশা করছি। সত্যি বলতে কি এই রোগটির নাম ঐ পোস্টের পরেই জেনেছি। সাতক্ষীরায় একটি ছেলের মাথা অনেক বড়, মাথায় পানি জমে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জেনে নিউরোসাইন্স ইন্সটিটিউটে তার অপারেশন করা হয়েছে। সিডোএফিড্রিন দিয়ে ইয়াবা বানানো হচ্ছে এমন একটি পোস্ট দেখার পর উদ্যোগ নিয়ে ইতোমধ্যে সিডোএফিড্রিন আমদানী নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নওগাঁয় বিরল এক স্কিন ডিজিজের কারণে একটি ছেলের শরীর পাথর হয়ে যাচ্ছে জেনে তারও চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতোগুলো উদাহরণ একটু আবেগতাড়িত হয়ে উল্লেখ করলাম শুধু এটি বোঝাতে যে এগুলো আমরা জেনেছি শুধুমাত্র সোশাল মিডিয়ার কারণে। সোশ্যাল মিডিয়া আর সিটিজেন জার্নালিজমের এই শুভ শক্তিকে কাজে না লাগিয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকাটা বোকামী নাকি আত্মঘাতি তা বিচারের ভার এই লেখার পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিলাম।
ফেসবুকের ‘পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশন বাংলাদেশ’ গ্রুপের গত ২/৩ মাসের কয়েকটি পোস্ট ‘মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা: জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা ও উদ্ভাবন বিষয়ক সোশাল মিডিয়া সংলাপ’ আয়োজনের পটভূমি হিসাবে কাজ করেছে যা সোশাল মিডিয়ার শক্তি ও অপরিহার্যতাকে স্পষ্ট করলো। সবচেয়ে বড় কথা সমস্যা জানতে পারলে সমাধান এর উদ্যোগ নেয়া যায়। কিন্তু রাজধানীতে বসে থেকে অনেক সমস্যাই জানা যায় না। মাঠ পর্যায় থেকে সমস্যা জানার ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া অসাধারণ অবদান রাখছে। স্টেন্টের দাম ভারতে দেড় লক্ষ রুপী ছিল যার দাম এখন ৩০ হাজার রুপী, যার দাম ছিল ৭৫ হাজার রুপী ছিল তার দাম এখন ৭৯০০ রুপী। ভারতে বিষয়টি কিভাবে করা হচ্ছে জেনে আমরা এখানে করার চেষ্টা করবো।
আমরা জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চাই। এটা একদিনের কাজ নয়। তবে সারাদেশে সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে এই পরিবর্তনের বার্তা পৌঁছে দেওয়া কেবল একা স্বাস্থ্য সচিবের কাজ নয়। সে লক্ষ্য মাথায় রেখে ২২ মার্চ ২০১৭ আমরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা: জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা ও উদ্ভাবন বিষয়ক সোশ্যাল মিডিয়া সংলাপের আয়োজন করি। এতে সকল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, সিভিল সার্জন, বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক, সিনিয়র চিকিৎসক এবং সিটিজেন জার্নালিস্টরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন। মুখ্য সমন্বয়ক এসডিজি মহোদয় সংলাপটি সঞ্চালনা করেন। ফেসবুক লাইভে প্রায় ৭০০০০ মানুষ সারা পৃথিবী থেকে যুক্ত থাকেন।
আমি বিশ্বাস করি, আমাদের মাঠ পর্যায়ের সহকর্মীদের কাছ থেকে সোশাল মিডিয়ায়, এই আনঅফিসিয়াল চ্যানেলে, এই আউট অফ দা বক্স প্রসেসে, অনেক বিষয় জানা সম্ভব। সিটিজেন জার্নালিস্টরা আমাদের সাহায্য করতে পারেন। প্রশ্ন করে ও তথ্য দিয়ে। তাদের প্রতিপক্ষ না ভেবে স্বাস্থ্যসেবাকে জনবান্ধব করার পথে সীমিত সামর্থ নিয়ে সকলের একসাথে এগিযে যাওয়া দরকার। এখনও পুরোপুরি মধ্যম আয়ের দেশ হতে না পারা কোটি কোটি মানুষের ছোট্ট একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন যথেষ্ট কঠিন কাজ। আর সরাসরি জীবন-মৃত্যু জড়িত থাকার কারণে অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ যেন অসংযত হয়ে না পড়ে, চিকিৎসকদের যেন আমরা ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ না করে বসি এটুকু অনুরোধ শুধু করবো।
সরকারী কাজে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার আর সিটিজেন জার্নালিজমের ব্যবহারের বিষয়টি ক্রমশই জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। প্রতিদিন পরিবর্তন হচ্ছে। তবে পরিবর্তন নিশ্চিত করার জন্য সাহসের দরকার। আমরা সাধারণত প্রথা ভাঙ্গতে চাই না, বাক্সের বাইরে আসতে চাই না। আমি সচিব হিসেবে এর পরিবর্তন চাই। সেজন্য নিজেই প্রথা ভাঙ্গতে শুরু করেছি। আমি ভয় পাচ্ছি না কারণ আমি যা করছি তা কোনো না কোনোভাবে সরকারের জন্য সহায়ক হবে বলে মনে করছি। নাগরিক উপকৃত হচ্ছে, হবে। আমার দায়িত্ব এমন কিছু করা যার সুফল স্বাস্থ্যখাতসহ পুরো বাংলাদেশ পাবে। বিশেষ করে হতদরিদ্র নাগরিক পাবে। এর মাধ্যমে নিজের মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তিকে হেয় করছি নাকি সমুন্নত করছি সময়ই তার জবাব দেবে।
লেখকঃ সিরাজুল খান, সচিব, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ স্বাস্হ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।