আজ- রবিবার, ৪ঠা জুন, ২০২৩ ইং, ২১শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
Email *

শিরোনাম

  নমোফোবিয়াকে না বলুক নরনারী       Empathy, Patriotism & Commitment Group: একটু বিশ্লেষণ       বৃক্ষ রোপণের ৭ তারকা ও ১ শিল্পী       ‘পরিবর্তন চাই’ এর চার বছর       নামে কী বা আসে যায়       লৌহজং ‘সামাজিক আন্দোলন’ – আমার সুখ স্মৃতি       `একাত্তরের জননী’র সন্তানেরা       মনোয়ারাঃ সক্ষম সন্তানদের মরতে বসা মা       নদী-খাল উদ্ধারে সফল, সফলতার পথে এবং সম্ভাব্য অভিযান       মাছের পেটের রড থেকে গরাদঘরে       পাবনায় নৌ-র‌্যালিঃ নদী উদ্ধারে নতুন উদ্ভাবন       আক্রান্ত সিটিজেন জার্নালিজম       দক্ষিণাঞ্চলে দুই সপ্তাহব্যাপী নিম্নচাপঃ উদ্ভাবন ও সিটিজেন জার্নালিজম বিব্রত       আইনজীবীর হৃৎকম্পে কাঁপছে দেশ       পাবলিক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর প্রতিচ্ছবি       জনশক্তিতে উদ্ভাবন       ফেইসবুক, বাংলাদেশ সরকার এবং রাজার ঘণ্টা       অধ্যক্ষ অনিমেষ ও সোশাল মিডিয়া       জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবায় সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রথা ভাঙ্গার গল্প       শিয়ালের কামড় থেকে সোশাল মিডিয়ার কামড়    

ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিকঃ ৩৯৩ নট আউট

উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের হেলথ ভাল না জাতীয় খবর পড়তে পড়তে এমন একটি ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে, জেলা সদরের বাইরে আসলে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে না। ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিকের কাহিনী পড়ে মনে হচ্ছে ধারণা ভুল।

গরীবের ডাক্তার হানিফুল

মৌলভিবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার হানিফুল ইসলাম সুজন তার ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিক (সিসি) এ নিরাপদ প্রসব সেবা প্রথম শুরু করেননি কিন্তু প্রথম ১০০ প্রসব সেবার রেকর্ড করেছেন। শুধু সেঞ্চুরী নয় প্রথম ডাবল সেঞ্চুরীর রেকর্ডও তার। কোনো কার্যক্রমকে ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখতে পারা অনেক বেশী গুরুত্তপুর্ণ যা ভোগতেরা সিসি ধরে রেখেছে। ধীরে ধীরে অন্য সিসিতেও ছড়িয়ে পড়ছে নিরাপদ প্রসব সেবা। এখন কয়েকশো সিসিতে এ ধরণের সেবা চালু আছে। এ পর্যন্ত কোথাও কোন অঘটনের কথা শোনা যায়নি। এই সেবা চালু না করলে এই মায়েরা হয়ত বাড়িতেই অপ্রশিক্ষিত দাইয়ের হাতে হানিফুলের মায়ের মতো প্রসব করাতো।
২০০৪ সালে ৮ম শ্রেণীতে পড়ার সময় হানিফুলের মা প্রসবকালীন সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের কারণে মারা যান। বাড়ীর পাশে কমিউনিটি ক্লিনিক ছিলো কিন্তু সেখানে প্রসব সেবা প্রদানের ব্যবস্থা ছিলো না। ২০১২ সালে হানিফুল কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার হিসাবে যোগদান করে ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিকে। হানিফুল চায় তার মায়ের মতো কোন মা যাতে প্রসবকালীন সময়ে অকালে মারা না যায়। এখানেই কাজকে শুধু পেশা হিসেবে নয় নেশা হিসেবে গ্রহন করার আভাস পাওয়া যায়, যা সত্যিই বিরল।

সেবা ও সন্তুষ্টি

শুধু হানিফুলের ভোগতেরা নয় খানসামা উপজেলার হকের হাট কমিউনিটি ক্লিনিক, চান্দিনায় চিলোড়া কমিউনিটি ক্লিনিক, কুলাউড়া উপজেলার মোবারকপুর কমিউনিটি ক্লিনিকসহ আরও অনেক উজ্জ্বল উদাহরণ আছে। সম্ভবত এজন্যই অনেক উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বহির্বিভাগে গত কয়েক বছরে শতকরা ২৫ ভাগ রোগী কমে গেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আগে দৈনিক গড়ে সাড়ে ৪০০ রোগী সেবা নিতে আসতো। এখন আসছে গড়ে ৩০০ জন।  অন্যদিকে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় এবং বিনা মূল্যে ৩২ রকম ওষুধ পাওয়া যায় বলে দিন দিন সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বাড়ছে। সেবা সংখ্যাকে আমলে নিলে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রায় সাড়ে ৩৫ কোটির অধিক রোগী এবং প্রায় ৭৫ লাখ জরুরী ও জটিল রোগীকে যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করা হয়েছে। নানা রোগে আক্রান্ত প্রায় ৮০ থেকে ৯০ লাখ মানুষ প্রতি মাসে স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন। গড়ে একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে বছরে ১ লাখ ১০ হাজার টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে। আইএমইডির জরিপে দেখা গেছে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ৮২ শতাংশ এলাকাবাসী সেবা নেয়। আর দিনের হিসাবে গড়ে সেবা নেওয়া মানুষের সংখ্যা ৩৫ জন। পৃথক দুটি জরিপে এসব ক্লিনিক নিয়ে ৮০ থেকে ৯৮ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে।

কমিউনিটি ক্লিনিকের শুরু

স্বাস্থ্যসেবার দাতা আর গ্রহীতার দূরত্ব কমাতে ১৯৯৬ সালে ১০ হাজার ৭২৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক বা গ্রামীণ হাসপাতাল চালু হয়। ২০০১ সালে পরবর্তী সরকার ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেয়। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আবার ১৩ হাজার ৮৬৭টি ক্লিনিক স্থাপন করেন যার মধ্যে প্রায় ১৩ হাজারটি পুরোদমে চালু রয়েছে বলে জানা যায়। স্থানীয় জনগণ এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ একর জমি দান করেছেন। প্রকল্পের মাধ্যমে সৃজিত এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করছেন মাত্র একজন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি)। এছাড়াও কাজীর গরু গোয়ালে থাকার মতো খণ্ডকালীন সেবা প্রদান করছেন হেলথ এসিসট্যান্ট (এইচএ), ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার এসিসট্যান্ট (এফডব্লিউএ) এবং ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভিজিটর (এফডব্লিউভি)। একজন করে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) আছেন। প্রকল্প শেষে স্বাস্থ্য বিভাগের অপারেশন প্ল্যানের আওতায় বর্তমানে এসব কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালিত হচ্ছে।

অর্জন

ভোগ‌তেরা ক‌মিউ‌নি‌টি ক্লি‌নি‌কের এ উদাহরন প্রমাণ করেছে, চা‌ইলে প্রতি‌টি কমিউনিটি ক্লি‌নিক‌কে নিরাপদ প্রসব সেবা কেন্দ্র হিসাবে গ‌ড়ে তোলা যায়। ২০৩০ সা‌লের মধ্যে এস‌ডি‌জি বাস্তবায়নের টা‌র্গেট অর্জনে যা সহায়ক হবে এবং অর্জন করা সম্ভব হ‌বে মাতৃ ও শিশু মুত্যু বিষয়ক লক্ষমাত্রা। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায় নবজাতক ও শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, প্রজনন হার নিয়ন্ত্রণে সাম্প্রতিক সময়ে ১০টি সূচকে বাংলাদেশে সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে। ২০০৭ সালে প্রতি হাজারে ৬৫ জন শিশু মারা যেত। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা নেমে এসেছে ৪৬ এ। এ হিসেবে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে ১৯ শতাংশ।একই সময় জন্মের আগেই দক্ষ স্বাস্থ্য কর্মীর সেবা পাওয়া শিশুর সংখ্যা ৫৩ শতাংশ থেকে উঠেছে ৬৪ শতাংশে।

জা‌তিসং‌ঘের মি‌লে‌নিয়াম ডে‌ভেলপ‌মেন্ট গোল এর অন্যতম ছিল শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমা‌নোর ল‌ক্ষে কমিউনিটি ক্লি‌নিকগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয় যার মাধ্যমে গ্রা‌মের মানু‌ষের জন্য প্রাথ‌মিক স্বাস্থ্য প‌রিচর্যা, স্বাস্থ্য শিক্ষা, বিনামূ‌ল্যে ঔষধ, পু‌ষ্টি, গর্ভবতী, প্রসূ‌তি ও নবজাত‌কের সেবার ব্যবস্থা গ্রহন করা হ‌য়ে‌ছে। মাতৃ ও শিশু মৃত্যু রোধ এর জন্য সেইফ ডে‌লিভারী প্রয়োজন। ‌আর সেইফ ডে‌লিভারীর জন্য প্রা‌তিষ্ঠা‌নিক ডেলিভারীর বিকল্প নাই। ডে‌লিভারী করা‌নোর ক্ষে‌ত্রে মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপ‌জেলাধীন জাফরনগর উ‌নিয়নের ভোগ‌তেরা ক‌মিউ‌নি‌টি ক্লি‌নিক সারা বি‌শ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত সৃ‌ষ্টি ক‌রে‌ছে। শুধুমাএ এই ক্লি‌নি‌কেই এ পর্যন্ত ৩৯৩ টি নরমাল ডে‌লিভারী (৪টি যমজ) হয়ে‌ছে। এ‌তে কর্মরত সিএইচ‌সি‌পি হা‌নিফুল ইসলাম, সিএস‌বি জা‌মিরুন বেগম, প্রাই‌ভেট সিএস‌বিএ লি‌পি খান‌মের প‌রিশ্রম ও ক‌মিউ‌নি‌টি গ্রু‌পের ঐকান্তিক চেষ্টায় এ বিরল অর্জন সম্ভব হ‌য়ে‌ছে।

চারপাশে সমস্যা

অনেক কিছুই ঠিক নেই। ৬২ শতাংশ ক্লিনিকের নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। ৫৭ শতাংশ ক্লিনিকের অবস্থা ভালো নয়। ৪২ শতাংশের নলকূপ অকেজো, ৪০ শতাংশ নকশা অনুযায়ী তৈরি হয়নি, ৩৬ শতাংশের শৌচাগার নষ্ট এবং ২০ শতাংশ ক্লিনিকে যাতায়াতের রাস্তা খারাপ । কিছু ক্লিনিকের পাশ দিয়ে বিদ্যুতের তার গেলেও ক্লিনিকে সংযোগ নেই। আসবাব ও যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকার কথাও জানা যায়। মাঠপর্যায়ে জনবল না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিস্থিতি ঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করা হচ্ছে না। সিএইচসিপিরা অকপটে বলছেন, তাঁদের তিন মাসের প্রশিক্ষণ যথেষ্ট নয়। প্রেসক্রিপশন লেখার মতো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাদের দিয়ে করানো যৌক্তিক কিনা ভাবা দরকার। কিভাবে এগুলোকে কাক্সিক্ষত মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। পাস করা ডাক্তারদেরকেও পাঁচ বছর অন্তর রেজিস্ট্রেশন নবায়ন করতে হয়। এই যে সিএইসসিপিদের পেশাগত দক্ষতা যাচাই বা নবায়নের যৌক্তিক ব্যবস্থা নেই। অনেক ইতিবাচক দিক আছে। কিছু সমস্যার কথাও অনেকে বলেছেন। কিন্তু কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কারও কোনো দ্বিমত নেই।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম এই আলোচিত বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলেরও আগ্রহ রয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজ দেখে গেছেন। এই উদ্যোগকে বিপ্লব আখ্যা দিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ‘কমিউনিটি ক্লিনিক; হেলথ রেভল্যুশন ইন বাংলাদেশ’ নামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও পেয়েছেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মানজনক পুরষ্কার।

অপয়া ১৩

কমিউনিটি ক্লিনিকের বিশাল কর্মযজ্ঞ (১৩ রকম কাজ আর ১৩ রকম রেজিস্টার সংরক্ষণ করা) মাত্র একজন সিএইচসিপি করে থাকেন। তারপরও গরিবের ডাক্তার হিসাবে খ্যাত এই প্রায় ১৩,০০০ সিএইচসিপির (এক তৃতীয়াংশ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান) চাকুরীর নিশ্চয়তা নেই এবং একই বেতনে কাজ করে চলেছেন দীর্ঘ সময়। দুমাস থেকে বেতনও পাচ্ছেন না। এই কর্মীরা নিয়োগ পেয়েছিলেন চুক্তিভিত্তিক প্রকল্পে কিন্তু তাদের কাজের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে রাজস্বখাতে স্থানন্তরের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। ৫ বছরের চাকরি জীবনে এ পর্যন্ত ১৫ জন মারা গেছেন। কিন্তু এদের কেউ কোনো সুযোগ-সুবিধা পায়নি প্রকল্প থেকে। ৫০ টাকা করে কল্যাণ তহবিলে টাকা নেয়া হয়েছে যার সুযোগ-সুবিধাও তারা পাননি। প্রতিদিনই দু’একজন চাকরি ছাড়ছেন। ইতোমধ্যে চার শতাধিক সিএইচসিপি চাকরি ছেড়েছেন। প্রায় ৪০ শতাংশ সিএইচসিপির সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়ে গেছে।

কমিউনিটি ক্লিনিকের ধারণাটি প্রধানমন্ত্রীর চিন্তা থেকে এসেছে। তিনি প্রতি কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য একটি ট্রাস্ট ফান্ড তৈরির কথাও বলেছেন। তাই কবি হেলাল হাফিজের ভাষায় প্রধানমন্ত্রী সমীপে আর্জি…

‘‘দুঃসময়ে আপনি কিছু বলুন

একটা কিছু করুন’’।

ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিক ৩৯৩ নট আউট কিন্তু হানিফুল ইসলাম সুজনের মতো প্রায় ১৩,৫০০ কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার চাকুরীতে নট আউট থাকতে পারবেন কিনা এখনও জানেন না।

 

Categories: কার্যক্রম